ষড় দৰ্শন [ তুলনামূলক আলোচনা ] PDF Download

ষড় দৰ্শন [ তুলনামূলক আলোচনা ]

সুপ্রাচীনকাল হইতে আর্য্য জাতির জীবনযাত্রার ভিত্তি ছিল বেদ । বেদ অপৌরুষেয়, কোন মানব কর্তৃক রচিত নহে ৷ বেদ অনাদি, ইহার কোন আরম্ভ নাই । ইহা কোনও কালে পরিবর্তিত হয় না ৷ বেদ সত্যপ্রতিষ্ঠ, স্বতঃপ্রমাণ । বেদ যাহা বলিয়াছে সকলই সনাতন সত্য । বেদের উক্তি সম্বন্ধে কোনও প্রকার সন্দেহ পোষণ করা অপরাধ। মনুষ্যরচিত নহে বলিয়া রচয়িতার চারি দোষ অর্থাৎ ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা (প্রতারণা করার ইচ্ছা ), করণাপাটব ( ইন্দ্রিয়ের অপটুতা ) ইহাতে নাই । সহস্র সহস্র বৎসর ধরিয়া বেদের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশই ছিল আর্য্যজাতির জীবাতু। বেদ কঠিন সংস্কৃত ভাষায় লেখা ৷ ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কাহারও বেদ চর্চ্চায় অধিকার ছিল না ৷ ব্রাহ্মণরাই ছিলেন বেদের পাঠক ও ব্যাখ্যাতা। ব্রাহ্মণ যাহা বেদের তাৎপর্য্য বলিয়া বর্ণনা করিবেন, অপর তিনবর্ণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, শূদ্র, তাহা অবনত শিরে মানিয়া চলিবেন। অবশ্য “স্বাধ্যায়োহধ্যেতব্যঃ” এই শ্রুতিবাক্যে ত্রিবর্ণেরই বেদ অধ্যয়নের বিধান আছে, কিন্তু এই ব্যাপারে কর্তৃত্ব ছিল ব্রাহ্মণেরই ব্যাপক ।

বেদশাস্ত্রের এই সুদৃঢ় ভিত্তির উপর এক মরণতুল্য আঘাত হানিল সৰ্ব্বপ্রথম _বৌদ্ধধর্ম্ম । বৌদ্ধগণ বেদের নিত্যত্ব অনাদিত্ব অপৌরুষেয়ত্ব সকলই অস্বীকার ( challenge ) করিল। বৌদ্ধমতে, কোন প্রাচীন কালের [ঐতিহকে অন্ধভাবে মানিয়া সত্যের সন্ধান কস্মিনকালেও পাওয়া যাইবে না । সত্যকে জানিতে হইবে জীবনের অভিজ্ঞতা দ্বারা 1— যুক্তিতর্কবিচারের মাধ্যমে ।

বেদের চাতুবর্ণ-ভেদ, ব্রাহ্মণের প্রাধান্য, যজ্ঞাদি নিত্য ও নৈমিত্তিক কাৰ্য্য, আত্মতত্ত্ব, ব্রহ্মতত্ত্ব – ইহার প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে বৌদ্ধমত সোচ্চার হইয়া উঠিল । মানুষের জীবনে জরা, ব্যাধি মৃত্যু আছে । তাহা অব্যভিচারে দুঃখ আনয়ন করে । এ সব অনতিক্রম্যও বটে । এই সকলের কবল হইতে অব্যাহতি লাভ করিতে হইবে—বেদ মানিয়া নহে । এই সকল দূর করার উপায় নৈতিক জীবনযাপন, কাহাকেও ( ইতর প্রাণীকে পর্য্যন্ত ) হিংসা না করা, সর্ব্বজীবে সমভাবে ভালবাসা, চুরি মিথ্যা আচরণ হইতে বিরত থাকা, আহারে-বিহারে শুদ্ধ সংযমী হওয়া। শাস্তির এই-ই পথ ৷

বৌদ্ধধর্ম্মের উপদেশগুলি দেওয়া হইত তৎকালীন সকলের মাতৃভাষায় । ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সংস্কৃত ভাষা পণ্ডিত সমাজেই সীমাবদ্ধ থাকিত। লক্ষ লক্ষ নরনারী বৌদ্ধধর্মের শান্তিময় ক্রোড়ে আশ্রয় খুঁজিল। বৌদ্ধধর্ম্মের সহজ সরল শিক্ষা সকলেই অনায়াসে গ্রহণ করিতে উন্মুখ হইল । দুর্ব্বোধ বৈদিক আধ্যাত্মিক ভিত্তি হইতে সরিয়া গিয়া মানবসমাজ বৌদ্ধধর্ম্মের সুখবোধ্য নীতিকথার ভিত্তিতে স্থিত হইল । বৌদ্ধধর্ম্মের বিজয় অভিযান এক সহস্র বৎসর সগৌরবে জাতির জীবন পথ আলোড়িত করিয়া বৈদিক মার্গকে ক্ষীণপ্রভ করিয়া বিরাজমান রহিল । ইহার মধ্যে প্রায় তিনশত বৎসর—বুদ্ধের আবির্ভাব হইতে সম্রাট অশোকের

ছার পর্য্যন্ত—বৌদ্ধধর্ম্মের ‘স্বর্ণযুগ’। এই যুগে বৌদ্ধধর্ম্মের আলোক-বর্তিকা শুধু ভারতে নহে, সমগ্র এশিয়ার সর্ব্বোচ্চ সমাসীন রহিল ।
যে ধর্ম্মের মূলে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্বীকৃতি থাকে না, তাহা অল্পদিনের মধ্যেই বহুমতে বিভক্ত হইয়া যায় । একজন পণ্ডিত বিচার তর্ক দ্বারা যাহা স্থাপন করেন তদপেক্ষা অধিক সূক্ষ্ম বিচারক্ষম ব্যক্তি তাহাকে খণ্ডন করিয়া অন্য মত স্থাপন করেন—
যত্নেনানুমিতোঽপ্যর্থঃ কুশলৈরমুমাতৃভিঃ ।
এইজন্য বৌদ্ধধৰ্ম্ম অল্পকাল মধ্যেই সৌত্রান্তিক বৈভাষিক যোগাচার ও মাধ্যমিক এই চারি ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়িল। সৰ্ব্বং ক্ষণিকং ক্ষণিকং, দুঃখং দুঃখং, স্বলক্ষণং স্বলক্ষণং, শূন্যং শূন্য —এই হইল বৌদ্ধধর্ম্মের . দার্শনিকতার ধ্রুবপদ । ক্ষণিক- সৰ্ব্বাস্তিত্ববাদ স্থূলতম হইতে সৰ্ব্ব-শূন্যবাদ সূক্ষ্মতমে আরোহণ করিল— “ভিক্ষুপাদপ্রসারণ-ন্যায়ে।’ বুদ্ধদেবের শুদ্ধ সরল নীতিবাদ, দার্শনিকতার বেড়াজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল ।
অপর দিকে বৈদিক ধর্ম্মের সনাতন ভিত্তি উপেক্ষিত হওয়ায় আর্য্যধর্ম্মের মনীষিগণ দিশাহারা হইলেন। বৈদিক ধৰ্ম্ম যে সত্য ও শাশ্বত এ বিষয়ে তাঁহাদের অন্তরে বিন্দুমাত্রও সংশয় ছিল না। সুতরাং বৈদিক সনাতন ধর্ম্মকে রক্ষা করিবার জন্য কৃতসংকল্প হইলেন হিন্দু দার্শনিকগণ। তাঁহারা স্থির করিলেন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top